Friday, March 22, 2013

সেদিন চৈত্রমাস!




অনেকগুলো চৈতালী ভোর পেরিয়েও এমন সর্বনাশের ইশারা পাইনি । আজ ছাইরঙা কুয়াশার ভোরে হাঁটতে হাঁটতে পিচের পাকা রাস্তায় । দুপাশের শিমূল পলাশের সঙ্গী মহুয়া । মহুয়া সুখী ফুল ।  ফুল থেকে সবজে হলুদ ফলটুকুনিও ঝরে পড়ে  মনের সুখে  ।  সেই মহুয়া সরণী ধরে পথ চলায় যে মাদকতা, তা পেয়েছি আজকের ভোরে । হলুদ ফরাস পাতা  মহুয়া সরণী বেয়ে চলেছি আর পাশের গাঁয়ের আবালবৃদ্ধবণিতার কোঁচোড় ভরে সেই মহুয়া ফল কুড়িয়ে নেওয়া দেখে মন পৌঁছে গেল সেই লালপাহাড়ির দেশে...    

এবার পুজোতে বোলপুরে একদল মাদল নাচিয়ের সাথে আলাপ জমেছিল ।  ওরা শ্যামলা গাঁয়ের শ্যামলা একদল মেয়ে । সাথে কয়েকজনের মরদ। ওদের চিকন কালো চুল, খোঁপায় বাঁধা বকের পালক, হলুদ গাঁদার ফুল, রূপোর শুলগা । লম্বাটে চোঙাকৃতির "মাদল" তালযন্ত্রটিকে  আর গোলাকার তবলার মত "লাগড়া" বাদ্যযন্ত্রটিকে নিয়ে ওরা নাচে আর গান তৈরী করে । আর ওদের গান সৃষ্টির মূলে হল  চৈত্রমাসের মহুয়া উত্সব । মহুয়ার মৌ জমে ওঠে ওদের ঘরে ঘরে আর ওরা নাচে, গান করে । আজকের মহুয়া কুড়োনোর সেই ছবিটা দেখে বুকে সেই মাদল বাজার শব্দ পেলাম । 
আর মনে মনে বলে উঠলাম


 "ও মেয়ে  তুই কুথা যাস রাঙামাটির পরে
ধামসা মাদল, মহুয়া ফুল কুথায় আছে ঘরে ? "      


আজকের চৈতী ভোর উসকে দিল আমার বসন্তকে আরো একবার!  


Friday, March 15, 2013

আমার জীবনের তুমিরা !

আমার জীবনপাত্র উথলে উঠেছে  মনে দাগ কাটার মত অনেক "তুমি"র জন্যে ।  তাই তুমির কথা বলতে গেলে কাকে ছেড়ে কার কথা বলি!
ছোট্টবেলায় মায়ের শাসন থেকে রেহাই পেতে ঠাম্মাবুড়ির সাথে পুতুলের বিয়ে দেওয়া, রুটি বেলার খেলাখেলির সময় মনে হত  "থাক্‌না এই মানুষটা আমার সারাটা জীবন ভোর "তুমি" হয়ে !"
তারপর যখন উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডী পেরিয়ে কলেজে পা দেওয়া তখন বিজ্ঞান-প্রেমে হাবুডুবু আমার "তুমি" হয়ে উঠল কেমিষ্ট্রি, জীবনের ধ্যানজ্ঞান । স্নাতকোত্তর পার হল বিশ্ববিদ্যালয়ে দস্তুর মত দ্বিতীয় স্থান সেই "তুমি"কে ঘিরেই ।  তারপর সবকিছু ওলটপালট !
ছেঁডাছেঁড়া কবিতারা এল আমার সেই "তুমি" হয়ে.... ঘুমঘোরে পদ্যপুর পাড়ি দিলাম  । সঙ্গের সাথী হল সেই "তুমি"রা । গদ্য-পদ্যের জগত ঘিরে কত "তুমি" সেখানে!  এছাড়া আমার "তুমি"র লিস্টিতে ব্যালকনির টব-বাগানের তরতাজা ফুলগুলো অথবা অলসদুপুরের খুনসুটির সাথী সেই কাঠবিড়ালী অথবা বসন্তবৌরীরা থেকেই গেছে মনের খোরাকের "তুমি" হয়ে ।
রক্তমাংসের "তুমি" এল জীবনে  । তাকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন ডাউনলোডিং হৈ হৈ করে ব্যান্ডাউইডথ পুড়িয়ে । জীবন-কেমিষ্ট্রি বদলে দিল  সেই "তুমি"র মা ডাক।
আবার ঋতুচক্রের ঝরাপাতায় ফাগুনের ফেসবুক দিল কিছু ম্যাজিক-মূহুর্ত । তখন অনেক "তুমি" ভালোলাগার, ওঠাবসার সঙ্গী । যেমন সন্ধ্যেবেলার "তুমি" বা ভোরের আলোর অন্য "তুমি"রা ।  
আর আছে আমার চারপাশে সেই অদৃশ্য "তুমি" যে আমার কোঅর্ডিনেটর, সঞ্চালিকা যাই বলো । 

Monday, March 4, 2013

কন্যে আমি

আবার আমায় নাও না কোলে তুলে কিম্বা নাহয় ঠাঁই দাও মাগো তোমার জরায়ুতে,
এবার দশ-মাস দশ-দিন নয়, থাকবো মাগো সারাজীবন ধরে । 
এই সমাজের চেয়ে বোধহয় ভালো ছিল তোমার পেটের ভেতরটা,
শোণিত-লোহিতকণার মাঝে রক্তমাংস'দলাটা ।
তবুও তো আমি সুরক্ষিত সেখানে
ভিতর-বাহিরে অন্তরে অন্তরে ঠিক যেমনি ছিলাম
তোমার মনের মাঝখানে ।   

Saturday, February 23, 2013

চুপকথা

পালটে গেল আমার চুপকথার গল্প ।  ১৯৮৯ র ফাল্গুন । অষ্টমঙ্গলা সেরে মধুচন্দ্রিমা...
সুদূর ডালাসে পাড়ি দেওয়া, জীবনের প্রথম প্রেমিকের সাথে,
বহু প্রতীক্ষিত বায়ুপথে ভ্রমণ.. বিমানবন্দর থেকে একে একে চোখের বাইরে চলে গেল মা, বাবা আর ভাইয়ের ছলছল চোখ,
চোখে তখন আনন্দাশ্রু, নিমেষে কষ্ট উধাও.. হাত ধরল কাছের মানুষটি,
অনাবিল আনন্দে হারিয়ে গেল তারা । সে দেশের মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম জানালাম নিজের দেশমাতৃকাকে...
প্রথম ভোরবেলা, কিচেন-ব্লাইন্ডস সরিয়ে, পার্কিং লটে  সার সার গাড়ির ছাদে দুধসাদা বরফের চাদর.. তার সাথে সূর্যের আলোর মাখামাখি,  
সত্যি রূপকথা হল আমার চুপকথারা ।
আমি হাত নেড়ে বাই করছি আমার স্টুডেন্ট স্বামীকে । গাড়ির মাথায় বরফ সাফ করতে করতে সে বেমালুম ভুলে গেল তার প্রেয়সীকে হাত নাড়ার কথা ।
তখন শুরু হল জীবনের বাস্তব গল্প ।   

Sunday, February 10, 2013

ভ্যালেন্টাইনস ডে

আমার ভালোবাসার  গান ভাসতে ভাসতে চলল । ভোরের আলোর পর্দা সরিয়ে, কচি রোদ্দুর গায়ে মেখে গান চলতে লাগল । একটু থামা আবার ফিরে আসা । এই ভাবে গীতবিতানের জানলা খুলে আবার ভাসে গান । ভালোবাসার গান । ক্রমে সন্ধ্যের অন্ধকারের পরত ছিঁড়েখুঁড়ে ভালোলাগার গান এসে পড়ল গানভাসি সাঁঝে । এই ভাবে আমার স্বপ্নপথে ভালোবাসার গান এসেছিল সেদিন ।
 গত শনিবারে খুব তাড়াহুড়োয় মেলাব‌ইয়ের মাঝে তোমাদের ষ্টলে গিয়ে কোনো পরিচিত বন্ধুর সাথে দেখা হয়নি তাই একটু আফশোস ছিল । সেই অপূর্ণতা নিয়ে রাতে ঘুমিয়ে এই স্বপ্ন দেখেছিলাম ভালোবাসার গান নিয়ে । তারপর ধড়মড়িয়ে উঠে দেখি গান আমার মনখারাপের উঠোন পেরিয়ে, স্বপ্নপথ বেয়ে সোজা আবার আমার পাশে লাইভ । খুশির ভালোবাসার আসন্ন দিনে আমার  সব বন্ধুদের জন্যে র‌ইল অনেক অনেক ভালোবাসা । বসন্ত আজ না এলেও ভালোবাসা বেঁচে থাকবে।

ভ্যালেন্টাইনস ডে তো উপলক্ষ মাত্র !

খোলাচিঠি ফাগুণ ডেটে

আজ এ ফাল্গুণের দ্বিতীয় ডেট । আজ দখিনের খোলা জানলায় সব ওলটপালট । ফাগুণের ওমে শীত লুকোল শুকনোপাতায় । পলাশের হাসিতে শীত-ফুলেরা মুখ ঢেকেছে  চুপিসাড়ে । শিমূল, অশোকের হট্টমেলায় ডালেডালে কাঁচা সবুজের ছোঁয়া ।  মাতাল বসন্তে রঙীন প্রকৃতি । তবুও তোমাকে চাই এই ফাগুণসন্ধ্যেয় । 

আজ দেখ, নতুন বসন্তের পাগলা হাওয়ায় উদাস তুমি-আমি ।  ঠাকুরঘরে সাঁঝেরবাতি, রাতের পোষাক, ডিনার টেবিল এলোমেলো আজ । তবুও তোমাকে চাইলাম । 
 কোকিল পাগল করেছে আমার  গানবিকেলের একটুকরো বারান্দা । জানো ? আমি কিন্তু বসন্তের নরম শাড়ির আঁচল বিছিয়ে বসে আছি সেই ফাগুণডেটের পথ চেয়ে । তাই আরো একবার সব বন্ধুদের মাঝে তোমাকে চাইলাম নতুন এই ফাগুণে ।

 না হয় একটা সন্ধ্যের মত শিকেয় তোলা র‌ইল সব চাওয়াপাওয়া, থোড়বড়ির সেই একেঘেয়েমির রান্নাঘর আর কূটকাচালি  ! গানে গানে না হয় ফিরিয়ে দিলে আমার একটা চুপকথার সাঁঝ !

ওরে পলাশ !!!

আজ খুকুর বড্ড মনখারাপ, কেন মাগো দোলের খেলার শেষ? 
আজ যে শুরু চৈত্র বিকেল বড়, আজ যে খুকু শাড়ি পরেছে বেশ্! 

আজ যে খুকু  ফ্রিল দেওয়া ফ্রক ছেড়ে, গরম বিকেল নরম ছাপাশাড়ি । 
আজ যে খুকুর উচ্চমাধ্যমিক, তাই সে বিকেল দোলের সাথে আড়ি ।

আজ যে খুকুর ছবি আঁকার ছুটি, গানের ক্লাসে বড্ড অনিয়মিত
আজ যে খুকুর ভাল্লাগেনা কিছুই,  দোলপিঁড়ি তার শূন্য, পরিমিত ।

আজ যে খুকুর খোঁপার পলাশকুঁড়ি, শুকিয়ে মলিন রাঙামাটির পরে ।
সব যে ওরা পেড়ে নিয়ে গেল, ছাতিমতলায় গৃহবাসীর দ্বারে ।

তাই তো খুকু দোল খেলেনি আজ, কমলা পলাশ মনখারাপে কেঁদে 
লালমাটিতে ফাগ উড়েছে শুধুই, হলদে শাড়ি সবুজ চাদর বেঁধে ।

নতুনবছরের খোলাচিঠি


আজ  ১৪১৯ এর "ফ্রাইডে দ্যা ফার্স্ট" ডেট তোমার সাথে আমাদের !  
একফুটের এই নীল আকাশের গুগ্‌লদ্বীপে বসে আমি ও আমরা । আর তুমিও সেই দ্বীপের অন্যপ্রান্তে । স্যাটেলাইটের কৃপায় তোমার ঐ আটপৌরে আভিজাত্য আর আমার এই সাদামাটা কলমচি । রকমারি গান তোমার টেবিলে ;  কেটার করছ তুমি তারার পিসিআরের বন্ধুদের সাথে, ফরমায়েশ বা আবদারের মাল্টিপ্‌ল চয়েস   । পুরোণো দুষ্প্রাপ্য গানের হাতছানি  কিম্বা  নিছক  আধুনিক গান সেই গানছবির মোড়কে ....... 
আমার তখন গা ধুয়ে নরম শাড়ি আর তুলসীতলায় সাঁঝবাতি জ্বেলে  ছুট্টে এসে  মাথার ওপর ফ্যান । এক আঙুলে ল্যাপটপ আর অন্যতে খোলাটিভির রিমোট; এলসিডি জানলার বিকিনি পর্দা সরিয়ে আমি বসে.....
বন্ধুবৃত্ত ছাপিয়েছে দ্বীপের চারিধারে । 


"শ্রীপর্ণা বলছি..." "হ্যালো রিণি আমি মিশমিদি বলছি" কিম্বা "আমি মৌসুমী গুপ্ত বারাসাত থেকে"  কিম্বা ছন্দা নন্দী ভি আই পি রোড থেকে   আর বয়োজ্যেষ্ঠা সুলতানাদি ?  কখনো আবার বরানগর থেকে অনির্বাণ বা বেলঘরিয়ার সুনীলদা । রান্নাঘরে দৌড়ে গেছি হয়ত রাতের খাবার গরম করতে.... সল্টলেক থেকে পাপিয়ার অনুরোধ এল  । এবার কালীঘাটের নন্দিনীদি কিম্বা দেবযানীদির স্বতস্ফূর্ত স্মৃতিকণা  ! কখনো বা অরুসার্কর দৃপ্ত কন্ঠস্বর !

ঝড় উঠল এবার । অকালবোশেখি । দরজা জানলা দৌড়ে বন্ধ করছি । টুপটাপ ঝাপটায় ভিজে সারা আমার শাড়ীর আঁচল ! দুমদাম বাজ কড়কড়ানি,  শন্‌শন্‌ হাওয়ার মাদল !   ঝড় উঠল তোমার দফতরেও । অভিযোগের, অনুযোগের  ফুলকি এসে পড়ল । তুমি হাসিমুখে সেই ঝড় সামলালে বন্ধু । আবার গানভাসি এলসিডি অলিন্দ । সেই জোয়ারে শেষগানের অনুরোধে কোই জিতা কোই হারা ।


এ আমাদের বড্ড পাওয়া ! আজ তাই একটাই কথা বারবার বলতে চেয়েও যা বলা হয়ে ওঠেনি এতদিন তা হল রিণি তুমি আমাদের ঋণি করেছ অথবা যদি বলি

বৃষ্টিগানে পাগল আমি শিউলিগানে আকুল 
হিমেল গানে পেলাম অনেক, বৈশাখিতে ব্যাকুল    !

আর সেও তোমার জন্যে !

বিষ্টিছাড়া

বর্ষামায়ের মিষ্টি মেয়ে, সৃষ্টিছাড়া বিষ্টি
আসছি, আসব করছে শুধু যত অনাসৃষ্টি ! 
কেমন যেন ভাল্লাগেনা বিকেল বিষ্টিছাড়া
কেমন যেন একলা শুধু আমি পাগলপারা ।

অধরা

তিন তিনটে ঝিরিঝিরে বৃষ্টি সপ্তাহ পার করে একছুটে তোমার কাছে ।
বৃষ্টির জন্যে মনখারাপ করতে করতে সবকিছু আপসেট । সেই কলেজবেলা  গুলো যেমন ওলটপালট হ'ত । কবিতা আসতনা কাছে । আচমকা অকালবৈশাখির বিকেলের মত একটা ভালোলাগা গান শুনে একদৌড়ে  বসে যেতাম খাতা কলম নিয়ে । বৃষ্টি উথালপাথাল করে দিত সবকিছু  । নিজের কাছে সেই ভালোলাগা গুলো ঘুরে ফিরে আসে বারবার । একটা গান বদলে দেয় সন্ধ্যেটা । পালটে যায় মনের আশপাশের পরিচিত আবহ । কলমের মধ্যে খুঁজে পাই নিজেকে । আমার বৃষ্টির ফোঁটা আর কলমের কালির ছিটেতে মিলেমিশে তখন একাকার আশপাশ । ঘড়ির কাঁটা থমকে যায় । বদল হয় দৃশ্যপট ।
খরার মধ্যেও সেই অধরা দুফোঁটা বৃষ্টিকে বারবার খুঁজে নিয়ে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে ।
ভালোবেসে দুঃখ পেতে ইচ্ছে করে ।  বারবার ভাবি যদি বৃষ্টি নামে ! যদি দুলাইন কবিতা পায় আমার !  

থামবো কি!

সে বার অতিবৃষ্টি হয়েছিল । থৈ থৈ শ্রাবণের পথঘাট । উপছে পড়া জলের ভারে নদীনালা বানভাসি । গাছপালা ফুলপাতার মনে হয়েছিল হাঁফ ছেড়ে বাঁচি ।  আর চাইনে বৃষ্টি ! এবার থামবি তোরা ? মেঘ বিদায় দিবি? টুপটাপ, ঝরা বকুলও সিক্ত, কদম ঝরা সন্ধ্যে নিঝুম শান্ত ছিল । মাটি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ছিল জলের থেকে ।   মেঘ মিনারে ফাটল ধরেছিল । বৃষ্টি কেঁদে চলেছিল অঝোরে । রোদের মুখ দেখেনি সবুজ ঘাস বহুদিন । এই বার্তা বোধহয় পৌঁছে গেছিল  বৃষ্টির দেবতার কাছে । মেঘের কাছে চিরকূট পৌঁছেছিল । তাই বুঝি বৃষ্টি এবার থেমেছে । বুকের কষ্ট চেপে রেখেছে মেঘ অতিকষ্টে । কোথায় থামতে হবে বুঝতে পেরেছে এতদিনে । প্রকৃতির এমনটি যদি প্রাণীকুল বুঝে নিত ! কোন্‌ এক অদৃশ্য মেল এসে যদি জীবজগতকে বুঝিয়ে দিত ! তাহলে না হত কোনো অপ্রয়োজনীয় টানাপোড়েন বা মনকষাকষি ।   তাহলে সব সম্পর্কের খুঁটিনাটিগুলো নিয়ে সারাজীবন নিয়ে চলা যেত । আর সম্পর্কের কাঁটাতারের বেড়া না ডিঙিয়েও বেশ সুন্দর বেঁচে থাকা যায় ।  

নিঃশব্দ স্মৃতিতর্পণ

একটা কেমন স্তব্ধতা !
অন্ধকারে হাতড়ে মরি, শিল্পী তোমার শূণ্যতা
আকাশ ভরা তারার মাঝে, নায়ক তোমার পূর্ণতা ।
রাতের গায়ে দিন ঢলে যায়, গড়িয়ে চলে সময়টা
আনন্দের এই জীবন সফর, ব্যস্ত ইঁদুর-দৌড়টা  ।
সাঁঝসবেরে, নীল আকাশে ভোকাট্টা সেই ঘুড়িটা
কেমন জানি হাতড়ে মরি, সুপারস্টারের শূণ্যতা !

জীবন? সে তো অনেক দিল,  কমিয়ে দিল আয়ুটা
নায়ক ! তুমি ঘুমিয়ে থেকো, কাটাও সুখের স্বর্গটা !
আকাশ যেন ঝলসে গেল, বদলে গেল দৃশ্যটা
একটা তারা খস্‌ল পড়ে, থম্‌‌কে গেল শহরটা !
কোথায় যেন হারিয়ে গেল, জ্বলজ্বলে সেই তারাটা
দম্‌কা বাতাস উড়িয়ে দিল, শুটিং স্টারের ফুলকিটা !
শূণ্য ঘরে, একা আমি থম্‌‌কে ঘড়ির কাঁটাটা
হঠাত ! যেন একলা ঘরে শিল্পী তোমার স্তব্ধতা ! 

বন্ধু

শিকেয় তোলা শপিংমল, এলোমেলো রাজ্যপাট 
রমরমিয়ে রঙীনছবি ,  চুলোয় গেল বাজারহাট !  
আবছায়ার বৃষ্টিপথে গান  ভাসাল ঘর দুয়ার 
সব ছেড়েছুড়ে বন্ধু আমার শ্রাবণের শেষ শুক্রবার !
 
কোথায় বন্ধু রঙতুলিটা কোথায় তোমার প্যালেট ?
আমার খোলা সেই পার্চমেন্ট চিঠিলেখার শেলেট ।
কোথায় বন্ধু নীলখামেতে উড়োচিঠির ভেলা ?
আমার খোলা সেই জানালা টুকরো চিঠির মেলা ।

কোথায় বন্ধু নীলনির্জন আউল-বাউল গান ?
আমার ছাদের সেই কোণাটায় রূপোর চাঁদের স্নান ।
কোথায় তোমার শেষ কবিতা থমকে গেছে বলো?
খুঁজে দেব সেই পাসওয়ার্ড যাই দুজনে চলো । 
--

মা

আমি তখন ঘুমবিছানায় মায়ের কোলে আলো ।
পাড়ার লোকে বলেছিল, পেত্থম মেয়ে হ'ল?
মা বলেছিল তা কেন ? আমার প্রথম বন্ধু সে ।

সারাক্ষণের ওঠাবসার একরত্তি  মেয়ে ! 

আমি তখন দুই বিরুণি,  শুরু স্কুলের বেলা
মায়ের সাথে ছন্দেসুরে  গানবিকেলের খেলা ।

আমার তখন কলেজবেলা, খড়কেডুরে শাড়ি
মা চেনালো  কলেজপাড়া, মিনিবাসে বাড়ি । 

আমি তখন ঊণিশ বছর, আমার স্নাতকোত্তর 
মা-মেয়েতে ঘোরাঘুরি,   রূপবাণী চত্বর ।

আমার তখন সপ্তপদী, আমার কুসুমডিঙে
ছাদের কোণায় মা যে কাঁদে আমায় ফাঁকি দিয়ে ।  
আমি কেবল থোড়-বড়ি আর জঞ্জালেরি ভীড়ে
কাজলাদিদির পায়ের নূপুর, কমলালেবুর শীতের দুপুর 
বর্ষাদিনের কাজরী গান,  মায়ের সাথে বিষ্টি স্নান
সবটা যেন ফুরিয়ে এল  কেমন চুপিসাড়ে । 

আমার ঘর

আমার একচিলতে ঘর আছে যার মালিক এক ইথারকন্যা । ধরণীর ক্লান্ত  সরণি বেয়ে এসে পৌঁছেছি আমি সেই ঘরে ।
আমি ছাড়াও সেইঘরে আছে আমার প্রিয় মুখ আর নিকট বৃত্ত ।
ঘরের পাশে একফালি বারান্দায় পড়ে ভোরের রোদ্দুর । মাথায়  পাকা ছাদ, ঝমঝম বৃষ্টি পড়ে যার ওপর ।
ঘরের  চৌকো জানলার গরাদ ধরে, বিকিনি পর্দা সরিয়ে আমি থাকি শরতের শিউলিঝরায়, গ্রীষ্মের রোদের আঁচে আর বর্ষার কালোমেঘের চোখরাঙানিতে । 

ঘরের বাইরে লাল মোরামের বর্ডার দেওয়া টিয়াসবুজ ঘাসের ফরাসে পা দিয়ে আমি হেমন্তের শিশিরের শব্দ পাই । 
আর বসন্তের কোকিল যখন ঘরের লাগোয়া সজনেগাছের ডালে বসে ডাক দেয়, সজনেফুলের গন্ধে ম ম করে ঘরের আশপাশ   তখন আমি ঘর করি সেই ইথারকন্যার সাথে  যার নাম কবিতা ।
আমার ঐ ঘরেই তার সাথে সারাক্ষণের ওঠাবসা, ভালোলাগা, মন্দলাগা। কবিতার সাথে সহবাস আবার সহমরণও । 
আর ঐ ঘরেরই জন্ম নেয় আমার ও কবিতার অপত্য ভ্রূণেরা... শব্দকণা হয়ে যারা ঝরে পড়ে টুপটাপ ঘরের মাটিতে, দেওয়ালে, আনাচেকানাচে.....  সেই আমার অর্ধেক আকাশ,  একভুবন আলো করা ঘরে....  
ভাগ্যি কবিতা ছিল সাথে ।  পেলাম মুক্তির ঠিকানা, তেপান্তর পেরোণো সেই আলোর মুক্তি  ।
আর ভাগ্যি ছিলি এই পোড়া ঘর আমার! বসত করেও সুখ পেলাম আমরা দুটিতে ।   

রং বদলায়

ছুটছে কচি, হাসছে কাঁচা,  রং'টা কেমন বদলে যায় ! 
দুষছে মানুষ, কাঁদছে মেয়ে ঢং'টা কেমনি সয়ে যায় ! 
পড়ছে গাছের কচিপাতা, শীতটা কেমন এসে যায় ! 
ঝলসে গেল কত জীবন,  গ্রীষ্ম  যেন সয়েই যায় ! 
বাদাম গাছে কচি পাতা, প্রেমটা যেন উথলে যায়   
হেমন্তে সে হিমেল হাওয়া,  নতুন করে ফিরে পায় ।
দিন গড়িয়ে দুপুর ঢলে, পড়ন্ত সে রোদের গায় 
বুড়ো বাপের দাঁত পড়ে যায়, চোখদুটি যে আবছায়ায় ।  
ঋতুর রঙে চমক লাগে, মা যে কেন পালটে যায় ! 
বয়স ভারে,  গলার স্বরে শব্দটা যে বদলে যায় । 
ভাইটা যেন ছোট্টটি থাক,  সাজানো থাক খেলার ঘর  

বোনের যেন দুই বিরুণী, যাস্‌‌নে  যেন পরের ঘর ।  
দোলদোলানো ফাগের বিকেল, দুরন্ত সেই কিশোর খেলার   
শিউলিঝরা আগমনী গন্ধ আনে পুজোবেলার....

একটু আকাশ নীলচে লাগে, বন্ধু কেমন বদলে যায় !
একটু বাতাস ঠান্ডা আনে, মানুষ কেমন পালটে যায় ! 
জীবনটার  এই কত রঙে,  একটু সবুজ অবুঝ হয়
জ্যোত্স্না আলোয় বিষ্টি পড়ে,  একটা জীবন উলটে যায় !  
ছুটছে কচি, হাসছে কাঁচা,  রং'টা কেমন বদলে যায়

দুষছে মানুষ, কাঁদছে মেয়ে ঢং'টা কেমনি সয়ে যায় ! 

প্রত্যাশা

প্রত্যাশা নিয়ে ভাবতে ভাবতে অনেক কথা মনে পড়ে যায় রিণি । সেই যখন ছোট্টবেলা কোনো  ছবি এঁকে বা কবিতা লিখে মায়ের কাছে ছুট্টে গিয়ে বলতাম "মা দ্যাখো, দ্যাখো"  । মা কোনো দিনো  discourage করেন নি কিন্তু কখনো পিঠ-চাপড়াতেন না আনন্দের আতিশয্যে । আমি একটু কিন্তু মনে মনে আপসেট হতাম ।    ছোট থেকে সেই এম এস সি অবধি রেজাল্ট হাতে বাড়ি এলেও মা যেন ভাব করতেন " কত ছেলেমেয়েরাই তো ভালো করছে, ঠিক আছে,  ভালো তো,   carry on ! বড়জোর চিবুকটা ধরে মাথায় হাত রেখে বলতেন "  লক্ষ্মী মেয়ে ! । আমার তখনো মনে হ'ত জানো রিণি, মা কেন আমাকে  খুব ভালো কিছু বলছে না ! এরপর বিয়ে হল । শ্বশুরবাড়ি যাবার আগে মা বলেছিলেন " কারোর কাছ থেকে কোনো কিছুর প্রত্যাশা করবেনা । মনে করবে নিজের সংসারের জন্যে করছ, পরের ঘরে কোনো " হাততালি" আশা করবে না"
আমি যখন প্রথম শ্বশুর বাড়ি গিয়ে একটা পোলাও বানিয়েছিলাম । সেদিন সকলে চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়েছিল । শুধু আমার স্বামী বলেছিল "superb" ;  কিন্তু অন্য কারোর মুখ থেকে আমি সত্যি কোনো কিছু বাহবা শোনার প্রত্যাশার অপেক্ষায়  ছিলাম না কারণ মায়ের ঐ কথাটা মনে দাগ কেটে দিয়েছিল ।
আজ যখন এই  সৃজনশীল কাজকর্মের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখার তাগিদে প্রচুর লিখি, গান গাই মনের আনন্দে, ম্যাগাজিন সম্পাদনা করি তখন অক্লেশে এগিয়ে চলি কোনো কিছুর প্রত্যাশা না করে । কারণ সৃষ্টিশীলতায় যাদের বেঁচে থাকতে হয় তাদের প্রত্যাশার ঝুলি বোধ হয় খালি থেকে যাওয়াটাই বাঞ্ছনীয় । জীবন তো তবে লক্ষ্যশূন্য হয়ে পড়বে । 
তাই বলে সৃষ্টি তো আর থেমে থাকবেনা,  নিজের খেয়ালেই ফুটে উঠবে ফুল আপনার জন্যে আর procreation এর জন্য ফুটতে তো তাকে হবেই । ফুটে আবার ঝরেও যাবে সে কারো প্রত্যাশা না করে । নয়ত পৃথিবী চলবে কি করে । ফুল হয়ত  ঝরে যাবার সময় ভাববে কেউ তার কদর করলনা কিম্বা আদর দিল না কিন্তু ফুল তো নিজের জন্যে ফোটে না । আর তার মধ্যে যদি সৃষ্টিকর্তার ঝুলি উপছে ওঠে ভালোবাসায়, কিম্বা মুঠোফোনে বেজে ওঠে একরাশ শুভেচ্ছা সেটাতো  জীবনের  incentive তাই না ?

 "না চাহিলে যারে পাওয়া যায়" ...... এর মত উষ্ণ আর মনছোঁয়া ।   

আমার মহালয়া

আমার মহালয়ায়, বৃষ্টি ধোয়া শিউলি-উঠোন নরম রোদের আলোয় যখন চার ছেলেমেয়ে  মায়ের সাথে কাশের বন  পেরোয়  ।
আমার মহালয়ায়, থৈ থৈ আজ পদ্মপুকুর, শিশির ধোয়া মাঠ যখন তোমার-আমার আর সকলের পুজোর বাজারহাট ।
আমার মহালয়ায়, আগমনী সুরের রেশে আকাশবাণীর ভোরে,  শব্দতরঙ্গে ঢাকের ধ্বনি শাঁখের সুরে সুরে । 
আমার মহালয়ায়, মন কেমন করা সুর শোনাত সেই ঘুমচোখেরই ভোর, গম্ভীর সেইসব মন্ত্রপূত সুরের স্বরলিপি নিয়েই রয়ে গেলাম তোর ।

এখন মনে হয় মা অদ্রিজা'কে শুধাই :  

দেখেছিস মা তুই কখনো মহালয়ার ভোর ?
সেই আদ্যিকালের বাদ্যিবাজা  শিউলিফুলের ঘোর! 
শিউলিছোপা দশহাতি তোর কমলা রঙের শাড়ি!
তোর কাশের ঝালর ঢাকের গায়ে পেঁজাতুলোর সারি !
দেখেছিস মা তুই কখনো মহালয়ার ভোর ?    
সেই মাঝরাতের ঐ আগমনী-ভৈরবীর ঐ দোর !
শিশিরফোঁটায় দুব্বোঘাসে সবুজ কথা তোর 
খালিপায়ে একরত্তি মেয়ের  কত জোর ?
দেখেছিস মা তুই কখনো মহালয়ার ভোর ?  

কখনো কখনো

কখনো কখনো মনে হয়, পথের মত হারিয়ে প্রায় 
চলে যাব খেলনাবাটি ফেলে 
রেখে যাব টুকরো কথা, ফেলে দেওয়া ছেঁড়া ব্যথা 
হারিয়ে যাব নদীর মত ভুলে 
কখনো কখনো রঙ এসে যায় ভিজিয়ে দেয় কষ্ট
কখনো কখনো দমকা হাওয়ায় এলোমেলো অস্পষ্ট 
উথালপাথাল গানের কলি, এলোমেলো সব ছন্দ
ওলটপালট খোলাখাতা,  মানের জানলা বন্ধ 
কখনো সখনো হালকা আমি, আনেক আলোর মাঝে
কখনো আবার চাপের মাঝে,  সকাল-বিকেল-সাঁঝে
এমন করেই চলুক জীবন নানারঙের ভীড়ে
গল্পকথা, পদ্য গাথায় গানসিঁড়িটির তীরে 
শুধু কিছু চিহ্ননাম যদি রেখে দিতাম তুলে,
ঐ রান্নাঘরের মাচায় কিম্বা চিলেকোঠায় ভুলে !!!

অপেক্ষা

ছরের শেষে ফাগুনের হাওয়ায় মুকুলিত আমগাছ দেখে মনে পড়ে যায় বোশেখির কথা । ফুরফুরে দখিনা হাওয়াকে উড়িয়ে নিয়ে যায় চৈত্রের অকাল বোশেখি । অপেক্ষায় থাকি ভয়ে ভয়ে গরমের দিনগুলোর । পাতাঝরা দিনের শেষে , মেঘলা আকাশে বৃষ্টি যেন দুদন্ড জিরেন দেয় । তারপর জৈষ্ঠ্যের কালো মেঘের ঘনঘটা দেখে আকুল অয়ে ওঠে প্রাণ । মেঘ না মৌসুমী ? সেই অপেক্ষার অবসান হয়  আষাঢ়ের বৃষ্টির বার্তায় ।  শ্রাবণের ধারায়  ঝরে পড়ে আকাশের খুশি, বাতাসের আনন্দ । ভরা ভাদ্রের থৈ থৈ দেখে মনে পড়ে যায় নীল আকাশের গায়ে ভেসে চলা পেঁজা তুলোট মেঘের ভেলার কথা । আগমনীর আবাহন ফুটে ওঠে পান্নাপুকুরে শাপলা শালুকের রঙে । আবারো অপেক্ষা কাশের বনে, পদ্মপাতায়, ঢাকের আওয়াজে  শিউলির গন্ধ নিতে নিতে । আশ্বিনের সেই অপেক্ষা ভরিয়ে দেয় মাদুগ্গা দিন কয়েকের জন্যে । এবার বাতাসে হিম । কার্তিকের আকাশপ্রদীপ ভূত চতুর্দশীর অন্ধকারকে মোহময় করে তোলে । দীপাবলীর অপেক্ষায় আলোর উত্সবে মাতোয়ারা হ‌ই । হেমন্তের পাখি গান গেয়ে যায় । শীত আসছে সেই অপেক্ষায় নেচে ওঠে মনটা ।  এবার অপেক্ষা পৌষপার্বণের্, নবান্নের । নতুন ধানের সোনার রং ঝরে পড়ে সবুজ ক্ষেতে, বাংলার ঘরে ঘরে । যৌবনবতী  চাষীবৌটির অপেক্ষা । তার সারাবছরের চাওয়া-পাওয়ার  হিসেবনিকেশ মেলানোর পালা । এবার রংয়ের আগুণ লাগবে সেই অপেক্ষা । অশোক-পলাশ-শিমূলের রং লাগবে কচিকাঁচার গায়ে, কিশোর-কিশোরীর মনে । যদি একটুকু ছোঁয়া লাগে  সেই অপেক্ষায় । 
 আর আমাদের মত আদার ব্যাপারীর অপেক্ষার শেষ নেই । এক বসন্ত আসে, এক চলে যায় । আবারো শুনি  কোকিলের গান । আবারো
মাখি  ফাগুনের রং । আবার নতুন করে পাবো বলে সেই অপেক্ষায় থেকে যাই । আবারো তার অপেক্ষায় দিনগোনার শুরু হয় ঠিক যেমন প্রতি শুক্রবার তোমার সাথে আমাদের ডেটের অপেক্ষায় সারা সপ্তাহ বসে থাকি তুমি আসবে বলে  
প্রতি অণুপল গোনার অপেক্ষা শুধু   তোমার জন্যে ।

হঠাত ছুটি

হঠাত  ছুটি হলে আমি দেখি আলতাগোলা আকাশ । চুঁইয়ে পড়ে ফাগের রং টপটপ আমার গায়ে। হঠাত দ্বিতীয় হুগলী সেতু ডাক দেয় । অস্তরাগের আকাশ বয়ে খেয়ালী মন দেয়ালা করে ছুটির সাথে । কু-ঝিকঝিক শুনি আমি ।
হঠাত ছুটি হলে ভাসাই আদরের নৌকোখানি নীল আকাশের পুবপারে যেখানে আছে উড়োজাহাজের ওঠানামা। বিশাল মহানগরকে নীচে একা ফেলে রেখে আমি পেরোই বাতাসপথ । উড়োজাহাজের ডানায় মেঘ সরে সরে যায় । আমি পৌঁছে যাই ভিনরাজ্যে । নদীনালা পেরিয়ে, পাহাড়মাটি ছাড়িয়ে, খাদের খতরনক বাঁক কিম্বা রোমহর্ষক মোড় পেরিয়ে আমি যাই ছুটির সাথে ঘর করতে । অচেনাফুলের যৌবনগন্ধ নিতে নিতে ছুটির সাথে দুদন্ড জিরেন হয় আমার ।
হঠাত চোখ মেলে দেখি ব্যস্ত মহানগর । আবার শহরের ভাঙাগড়া । আবার ছুটি । এভাবেই চলে জীবন । এভাবেই ছুটির সাথে ওঠাপড়া । মহানাগরিক ভীড়ে ছুটিকে চিঠিলেখা । হঠাত ছুটির পথ চেয়ে বসে থাকা । আবার হঠাত ছুটির নিমন্ত্রণে বেরিয়ে পড়া ।

আমরা আছি ও থাকব !

সুন্দর একটা অপ্রত্যাশিত শীতের সন্ধ্যে  । 
আমাদের এক ভুবন এই আকাশ, বাতাস, এক ঘর ডেট নিয়ে সন্ধ্যেটা আশা করি শেষ হলনা । রয়ে গেলাম আমরা সেই পুরোণো নৌকোর সহযাত্রী হয়ে ।   
যদি সত্যি আর কিছু মূহুর্তের পর চলে যেতে হত তাহলে অনেক কিছু অদেখা, অচেনা আর অজানার মধ্যে থেকে হাতড়ে নিতাম সেই মূহুর্তটাকে যখন ফুল পাপড়ি খোলে অথবা পাখীর ডিম ফুটে চোখ মেলে তাকায়  ছোট্ট  পক্ষীছানা । কিম্বা ফুলের গন্ধ নিতে নিতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গানের ভেলায় ভাসতে পারতাম । আরো যদি পারতাম বহুদিনের পুরোণো বন্ধুর সাথে মন খুলে গল্প করতে । আশপাশ ঘিরে থাকত পরিজন, প্রিয়জন আর আমি ঘুমিয়ে পড়তাম তাদের কলকল, খলখল গলার আওয়াজে। একটু তন্দ্রা, আধটু নিদ্রার ফাঁকে জেগে জেগে আধো ঘুমে আবিষ্কার করতাম অদেখা সেই মূহুর্তগুলো । বাঁচার ইচ্ছেটা আরো বেড়ে যেত । ভাবতাম কি সুন্দর  আমার এই একভুবন  জগত! কেন ফুরিয়ে যায় সময়? 

যাইহোক আমরা আছি ও থাকব ! 

শেষ-ডেট

আজ ১২র শেষ শুক্রবারের শেষ পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে ।  পূর্ণিমার চাঁদের রূপোলী আলোর বন্যা দেখে মনে হল শেষ-ডেটটা বেশ ঝলমলে আজ ।  এবছরের শেষ ডেটের প্রতীক্ষার অবসান অবশেষে । কুড়িয়ে নিলাম আঁচল ভরে অনেক অনেক ভালো মূহুর্তগুলো । জানিনা এমন মূহুর্ত এবছরে আসবে কি না । তুমি আমাদের করে নিয়েছ এই অনুষ্ঠানে তাই এটা আমাদের অনেকখানি পাওয়া ।  আরো কাছাকাছি এলাম পুরোণো- নতুন তারার বন্ধুরা । সেটাই অনেক পাওয়া ।   আমার অলস শুক্রবার গুলো ভরিয়ে দিয়েছ এই ডেটের মধ্যে দিয়ে । আগে শুক্রবার এলেই মনখারাপ করত ।

ছেলেটা হষ্টেলে থাকে বলে শনিবারের শপিংমল্, রবিবারের মাংস-ভাত কিছুই যেন  প্রাণ পাবেনা এই কথা ভেবে । কিন্তু আমরা তোমার সাথে এই ডেটে যেন নিজেদের উজাড় করে দিতে পারি । আমাদের সব মনখারাপ গুলো আছড়ে পড়ে নীলরংয়ের ঐ স্ক্রীনে । আমাদের পূর্ণিমা, অমাবস্যা, পুজো, দোল, নববর্ষ  সব যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে তোমার সাথে ভাগ করে নিয়ে । এখানেই এই অনুষ্ঠানের সার্থকতা ।
 সেই এক‌ই গ্রীষ্ম, এক‌ই বসন্ত, এক‌ই বর্ষা আর শীত সবকিছু যেন এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আবিষ্কার করেছি আমরা । আর সাথে গান তো র‌ইল‌ই হাতের পাঁচ । আমার জীবন ভরলাম কয়েককুচি ছেঁড়া ছেঁডা কবিতার কুচি আর অলস ভাবনার গদ্য দিয়ে আর গার্ণিশ করলাম চেনা গানের অচেনা সুর দিয়ে , চেনা গলার অচেনা শব্দ দিয়ে । তুমি আমাদের র‌ইলে বলে আরো পেলাম নিজেকে আপন করে । 

খুব ভালো থেকো সকলে।  সব বন্ধুদের জন্য নতুন বছরের শুভেচ্ছা র‌ইল । আর তুমি খুব ভালো থেকো !
 

গান, তোকে

 গান, 
তুই আমার সেই ছোট্টবেলার স‌ই  । আমার মনখারাপের একফালি মেঘ। মনকেমন করা  ইলশেগুঁড়ি । আবার আমার মনের দুকুল ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া ভরাকোটালের বান । স‌ই, তোকে এই চিরকূট লেখা যার জন্য সেই বন্ধুরা আমার তোকে বারবার মনে করিয়ে দেয় সকাল-বিকেল-সাঁঝে ।
শৈশবের আমার কপালে মায়ের হাত রেখে ঘুমপাড়ানি,  কৈশোরের কাজলাদিদি,  যৌবনের রবিঠাকুরের প্রেমপর্যায়, পরিণত "আমি"র কীর্তন-কোলাজ  তুই ! আবার কখনো আভিজাত্যের মুকুট পরে জলসাঘরের সিন্ধুভৈরবী কিম্বা মেঘমল্লারের মেখলা পরে । 
 তারপর কতকিছুর সাথে তোর-আমার ওঠাবসা, মন-কষাকষি ! 
তার মধ্যে এসে গেছে অন্য যুগ! তুই পালটালি । আমি বদলালাম । অর্কুট উঠোন ডিঙিয়ে, ফেসবুক ব্যালকনি ঘেঁষে সেই ইউটিউব  অপেক্ষা । শুধু তোর জন্যে স‌ই ! আমার জীবনমুখী গান তোকে ঘিরে। বাংলাব্যান্ডকে চিনতে শেখা সেও তোর হাত ধরে ।  আর কালজয়ী সব পঞ্চকবি সে তো তুই জানিস স‌ই !
ওহ্! বলতে ভুলেই গেলাম  তোর গায়ে সেই ঘেমো যৌবনগন্ধের পাগল করা গন্ধমাখা  কথা । তুই কখনো টুসু, কখনো ভাদু, কখনো ঝুমুর আবার কখনো  বিহু । নিপাট সাদামাটা তোকে দেখায় তখন ! কত প্রাণোচ্ছ্বল, কত গেঁয়ো একটা গন্ধ থাকে তখন তোর গায়ে । 
আবার তুই যখন সেজেগুজে রকস্টারের গা ঘেঁষে থাকিস, গিটারের তারে উঠে আসিস, নতুন প্রজন্ম মানে আমার ছেলের গলায় সেও তো দেখবার । গ্লিটসি, গর্জিয়াস ! সত্যি তোর এক অঙ্গে কত রূপ ! 
ওলো স‌ই ! আমাকে শুধু ভালো রাখিস । আর তুই বেঁচে থাকিস যুগ যুগ ধরে ঠিক এমনি করে । 

দেশ

দেশ-রাণীমা'র মাথায় বরফ মুকুট, হিমালয়ের সবুজ ঝালর বুকে
নীল-সবুজ নদীর ঘাগরা কুঁচি সাগর ঢেউয়ে ছুঁচ্ছে এঁকে বেঁকে ।
চিকন বালির কাঁকন হাতে পরে, রাণী পেরোন রূপনগরের উঠোন
উঠোন ঘেঁষে আমার বাড়ীর রোয়াক, পুবপারের ঐ খোলা হাওয়ার শহর ।
কোপাইপাড়ের মাটি উঁচুনীচু, খোয়াই সেথায় শুধুই যেন রাঙা
ছাতিমতলার গন্ধে কচিকাঁচা, সোনাঝুরির ধারে ভুবনডাঙা । 
দেশরাণীমা'র এমন কত বাগান, (ঠিক)আমার উঠোন পেরোলে যেমন সাগর 
গায়ের সোনা ছড়িয়ে দিয়ে ক্ষেতে, মা এখনো রূপসী ডাগর-ডোগর ।
উড়নি ওড়ায় গাঁয়ের ধানের গোলায়,  শিশির ছেটায় শিউলিঝরার বেলায়
দুচোখ ভরে মা'কে চেয়ে দেখি, দু'পা ফেলে ভাসি কাশের ভেলায় ।  

সাগর-স্বপ্ন

একটা বিকেল নেবে তুমি?
যার নোনা জলের সাদাফেনায় ছুটে আসা জলের ফোঁটার রঙ সাদা
যার সাদা উড়নি নোনতা স্বাদের ঢেউয়ের পরে ঢেউয়ের
আনাগোনায় আছড়ে পড়া বালির চরে আসর বসায় 

মুঠো মুঠো ঝিনুক, তারা মাছ, শঙ্কর মাছেরা 
দলবেঁধে আসা বকের সারি উড়ে যায় ক্যাসুরিনার ফাঁক দিয়ে, 
খেয়ে যায় বাঁশপাতা মাছ সমুদ্রের তট থেকে, 
ঢেউ এসে নিয়ে যায় বিকেলের সূর্যাস্তের রং । 
সব মনখারাপের দুপুরগুলো আছড়ে পড়ে সেই ঢেউতে । 
ক্লান্ত সূর্য তখন আপন মনে রঙ ছড়িয়ে চলে পশ্চিম আকাশের গায়ে...
রং ছড়াতে ছড়াতে অবসর নেয় ঠিক আমার মত
যখন আমার ইচ্ছেডানায় ভর করে সাগর-স্বপ্নেরা..

ছুটি

আজ আমার একরত্তি আলসেমি, আজ আমার ঘুমভাঙানির দেরী
আজকে ছুটি ভোরের হাঁটাহাঁটির, আজ চায়ের কাপে একচা-চামচ চিনি ।
দুপুরে না হয় কেবলি ফেনাভাত, সাথে সেদ্ধ-সবুজ অবুঝ ঘিয়ের হাত !
তারপরে একছুট্টে হাইওয়ে, হ্যালুসিনেটেড জয়রাইডে আমি
পেরিয়ে ধূধূ পলাশঝরা মাঠ একটু-আধটু গ্রামের মেঠো জমি !
শাল শিমূল আর খুচরো পথের ধূলো, ধানজমি আর সর্ষে ক্ষেতের আলো...
টুকরো টাকরা কথার কাটাকাটি, হাওয়ায় দোলে হলদে বাঁদরলাটি !
এফএম বকে কথা অনর্গল, ছুটির দুপুর খুশির অবাধ আগল ।

ঝাঁপ



 টাইমস অফ ইন্ডিয়ার "উদিতা" ম্যাগাজিনের আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত "ঝাঁপ" কবিতাটি  
বড়‌ই বেশি ভালবেসেছিলি
তাই আমি আজ "আমি" হয়েছিলাম
বলেছিলাম বাঁচতে শিখতে তোকে,
বড় বেশি বাঁচতে চেয়েছিলাম তোকে পেয়ে, তোকে নিয়ে
তাই সব স্বপ্নগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে আমার
বেঁচে থাকার, হৈ হৈ সব রসদেরা, মন খুশির রঙীন পসরা
আজো সব থরে থরে সাজানো রয়ে গেল।
তার মাঝে ভুলে গেলাম তোর পদবী,
তোর চিবুকের কালো জড়ুল,
ছায়া ঘেরা স্বপ্নের কুয়াশায়
এখনো দাঁড়িয়ে তোর আমার শিরীষতলা, ক্যাসুরিনা
তোর রোদ্দুর হতে চাওয়া, আমার বৃষ্টিগানের হাওয়া
ছিঁড়ে গেছে সেতারের তারগুলো
জীবনের কাছে আবার বেড়াতে যাব আমরা,
যাবিতো তুই আমার সাথে এবার ?
ব্রীজের নীচে দাঁড়িয়ে আবার দেখব
গঙ্গার ভাঙা পাড়ে রাঙা আকাশের সূর্যাস্ত
মাঝগঙায় তোর সাঁতার কাটা ;
ডুব সাঁতার আর নয় এবার
আমিও এবারে তোর সাথে ডুবতে রাজী আছি !